জেনে নিন ভেতরে বাইরে গাড়ির নানান রকম যন্ত্রাংশ সম্পর্কে

স্টিয়ারিং সিস্টেম থেকে সামনে ও পিছনের সাসপেনশন পর্যন্ত, একটি গাড়ি অনেক অংশ দিয়ে তৈরি করা হয়, যা আপনার গাড়িকে শক্তি সরবরাহ করে ও সুরক্ষিত রাখে। একটি গাড়িতে ৩০ হাজারের উপরে যন্ত্রাংশ থাকে। প্রত্যেক চালক, কারিগর ও মালিকের জন্য গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের নাম ও এর কাজ সম্পর্কে ধারণা রাখা অত্যাবশ্যক। অবস্থান ভেদে গাড়ির যন্ত্রাংশ দুই ধরনের— সামনের যন্ত্রাংশ এবং পেছনের যন্ত্রাংশ। এদের প্রত্যেকের মধ্যে আবার দুই ধরনের যন্ত্রাংশ বিদ্যমান— অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ এবং বাহ্যিক যন্ত্রাংশ। সাধারণত একটি গাড়ির সকল অংশই এই শ্রেণীবিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া কার্যকারিতা ভেদে গাড়ির সকল যন্ত্রাংশকে ৫ ভাগে ভাগ করা সম্ভব। যেমন: চ্যাসিস, ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন সিস্টেম, বাহ্যিক গড়ন এবং সহায়ক অংশ। এই আলোচনায় সকল যন্ত্রাংশ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

সামনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ

গাড়ির সামনের দিকে সাত ধরনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ থাকে। এগুলোর মধ্যে আছে ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন, ব্যাটারি, অল্টারনেটর, রেডিয়েটর, সম্মুখ সাসপেনশন এবং স্টিয়ারিং। সংক্ষিপ্ত রূপে এসবের কাজ জেনে নেওয়া যাক।

ইঞ্জিন ও ট্রান্সমিশন

ইঞ্জিনের প্রধান অংশগুলো হলো ইঞ্জিন ব্লক, পিস্টন, ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট, ক্যামশ্যাফ্ট এবং সিলিন্ডার হেড। ইঞ্জিন জ্বালানী শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে যা গাড়িকে গতিশীল করে। ট্রান্সমিশনের সমান হলো টর্ক কনভার্টার, প্ল্যানেটারি গিয়ারসেট, পাম্প, ক্লাচ, ব্যান্ড, সেন্সর, ভালভ বডি এবং এটিএফ। ট্রান্সমিশন চাকা এবং ইঞ্জিনের মধ্যে গিয়ার অনুপাতকে সামঞ্জস্য করার জন্য কাজ করে, কারণ গাড়ির গতি হ্রাস বৃদ্ধির সময় সুরক্ষিত ট্রানজিশন এর প্রয়োজন হয়।

ব্যাটারি

ব্যাটারি আপনার গাড়ি চালু করার জন্য শক্তি সরবরাহ করে। এটি গাড়ির কম্পিউটারের জন্য একটি সার্জ প্রোটেক্টর হিসেবেও কাজ করে। ইঞ্জিন বন্ধ থাকাকালীন এটি লাইট, স্টেরিও, জিপিএস বা ওয়াইপারের মতো জিনিসগুলির স্বল্পমেয়াদী ব্যবহারের জন্য শক্তি সরবরাহ করে।

অল্টারনেটর ও রেডিয়েটর

অল্টারনেটর রাসায়নিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করার জন্য কাজ করে, যেন আপনি আপনার ইঞ্জিনের ব্যাটারি এবং গাড়ির অন্যান্য বৈদ্যুতিক উপাদানগুলিকে চার্জ করতে এবং পুনরায় ব্যবহার করতে পারেন। অন্যদিকে, রেডিয়েটর ইঞ্জিন থেকে অতিরিক্ত তাপ দূর করতে সাহায্য করে। রেডিয়েটরের তিনটি অংশ রয়েছে— কোর, প্রেসার ক্যাপ, ও আউটলেট এবং ইংক্লেট ট্যাংক।

সম্মুখ সাসপেনশন

সম্মুখ এক্সলারও সম্মুখ সাসপেনশনের অংশ। সাসপেনশন গাড়ির রাইডিং নিয়ন্ত্রণ ও উন্নত করে। সিস্টেমটি গাড়ির টায়ার ও রাস্তার মধ্যে ঘর্ষণকে সর্বাধিক করে তোলে যা আপনার গাড়ি স্থিতিশীল রাখে।

স্টিয়ারিং

স্টিয়ারিং সিস্টেমের প্রাথমিক কাজ হলো অটোমোবাইলের দিক নির্ধারণ করা। স্টিয়ারিং সিস্টেমের মৌলিক কাজ হলো ড্রাইভারকে নিরাপদে ও সুনির্দিষ্টভাবে গাড়ি চালাতে সাহায্য করা। তাছাড়া এটি গাড়ির স্টিয়ারিংকে সাসপেনশন ও চাকার সাথে সংযুক্ত রাখে।

পেছনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ

গাড়ির পেছনের অংশেও অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রেকস, কনভার্টার, মাফলার, টেইল পাইপ, ফিউল ট্যাঙ্ক, এবং পশ্চাৎ সাসপেনশন। এখন দেখে নেওয়া যাক এই যন্ত্রাংশগুলোর কাজ কী!

ব্রেকস

প্রতিটি গাড়িতে দুটি সামনের ব্রেক এবং দুটি পিছনের ব্রেকের পাশাপাশি একটি পার্কিং ব্রেক থাকে। এগুলো একটি চলমান যানবাহন, চাকা, এক্সেলকে ধীর বা থামানোর জন্য বা এর গতি রোধ করার কাজ করে। গাড়ির ব্রেকগুলো ঘর্ষণ ব্যবহার করে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করে।

কনভার্টার

কনভার্টার বা ক্যাটালাইটিক কনভার্টার একটি ইঞ্জিনের ধোয়া থেকে ক্ষতিকারক যৌগ বাষ্পের মতো নিরাপদ গ্যাসে পরিবর্তন করতে একটি ক্যাটালাইটিক চেম্বার ব্যবহার করে। এই প্রক্রিয়ায় কনভার্টার তিন ধরনের কাজ করে। সেগুলো হলো নাইট্রোজেন অক্সাইড ভেঙ্গে মৌলিক নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনে রূপান্তর, কার্বন মনোক্সাইড থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের জারণ, এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানিতে হাইড্রোকার্বনের অক্সিডেশন।

মাফলার

অস্বাভাবিক ও অপ্রীতিকর শব্দ এবং ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গাড়িতে মাফলার ব্যবহৃত হয়। মাফলারগুলি প্রধানত ইঞ্জিনের পিস্টন ও ভালভ দ্বারা সৃষ্ট উচ্চ মাত্রার শব্দ অপসারণ করতে সাহায্য করে। গ্যাস নির্গমণ শক্তিশালী শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে, সেটি নিয়ন্ত্রণ করাই মাফলারের কাজ।

টেইলপাইপ/এক্সস্ট

টেলপাইপ হলো নিষ্কাশন ব্যবস্থার শেষ অংশ যা গাড়ি থেকে নির্গত গ্যাসগুলিকে বাইরে এবং দূরে নিয়ে যায়। এক্সস্ট পাইপ ছাড়া গাড়ি চালানো নিরাপদ নয়। এক্সস্ট ক্ষতিকর কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস গাড়ির নিচ দিয়ে বাইরে নিষ্কাশন করে দেয় যেন ক্যাবিন গুলোতে না জমতে পারে।

ফুয়েল ট্যাঙ্ক

জ্বালানী বা ফুয়েল ট্যাঙ্ককে পেট্রোল ট্যাঙ্ক বা গ্যাস ট্যাঙ্কও বলা যায়। এটি দাহ্য তরল পদার্থের জন্য একটি নিরাপদ ধারক। ট্যাংক ইঞ্জিনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করে।

পশ্চাৎ সাসপেনশন

লিঙ্কেজ, শক এ্যাবজরবার এবং স্প্রিংস হলো পিছনের সাসপেনশনের অংশ। রিয়ার এক্সেলও এর একটি অংশ। বিশেষত, সাসপেনশন সিস্টেম স্টিয়ারিং স্থিতিশীলতা এবং ভালো হ্যান্ডলিং প্রদানের জন্য টায়ার ও রাস্তার মধ্যে ঘর্ষণকে অনুরূপভাবে ব্যবহার করে।

বাহ্যিক যন্ত্রাংশ

বাহ্যিক যন্ত্রাংসের ভিতরে পড়ে গাড়ির বাহ্যিক গড়ন, লাইট, টায়ার, লুকিং মিরর, গ্রিলস, বাম্পার, কুলিং ফ্যান রেডিয়েটর, সিটস, জানালা, টায়ার, ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে নীচে আলোচনা করা হলো।

বাহ্যিক গড়ন বা বডি

গাড়ির বাহ্যিক গড়ন বা বডির মধ্যে আছে ইঞ্জিনের হুড, গাড়ির দরজা, চাকার উপর ফ্যানডারস, উপরের কভার আর সম্পূর্ণ বডি কভার। গাড়ির বডি তৈরিতে সবচেয়ে সাধারণ উপাদান হলো ইস্পাত। প্রতিটি গাড়িতে গড়ে ৯০০ কিলোগ্রাম স্টিল বা ইস্পাত ব্যবহার করা হয়।

লাইটস

একটি গাড়িতে কম বেশি ১৬ ধরনের লাইট থাকে। এদের মধ্যে হেডলাইট, ফগ লাইট, হুড লাইট, পার্কিং লাইট, সিগন্যাল লাইট, ট্রাঙ্ক লাইট, স্টপ লাইট, টেইল লাইট, লাইসেন্স প্লেট লাইট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো সবই আলাদা ধরণের লাইট, তাই বিভিন্ন সময় ব্যবহার করতে হয় ড্রাইভারকে।

টায়ার বা চাকা

গাড়ির চাকার প্রধানত তিনটা অংশ— টায়ার, রিম আর হাব। চাকার দুইটি প্রধান কাজ হলো ঘর্ষণ কমানো এবং লিভারেজ প্রদান করা। রিম চাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কারণ এটি রডগুলির চারপাশে ঘোরে যেগুলিকে অ্যাক্সেল বলা হয়।

লুকিং মিরর

গাড়িতে বিভিন্ন ধরনের লুকিং মিরর থাকে যেমন ইন্টারনাল ড্রাইভার, সাইড, ফ্রন্ট ভিউ এবং রিয়ার ভিউ মিরর। চালকের বসার অবস্থানের উপরে মিররের অবস্থান ও অ্যাঙ্গেল নির্ভর করে। গাড়ির মিররগুলোর কারনে গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি চালানোর সময় আশেপাশে সবকিছু তদারকি করতে পারে।

গ্রিলস এবং কুলিং ফ্যান

কুলিং ফ্যান গাড়ি ইঞ্জিন এবং অন্যান্য অংশ ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। আর গ্রিলস গাড়ির সামনে কুলিং ফ্যান রেডিওটার কভার করতে ব্যবহার করা হয়। গ্রিলসের কারণে গাড়ির সকল ধোয়া যেমন এয়ারকন্ডিশনের বাহ্যিক হাওয়া বের করে দিতে সাহায্য করে।

বাম্পার

গাড়ির সামনে ও পিছনে দুইটি বাম্পার থাকে। বাম্পার হলো একটি শিল্ড। এটি একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করে যেন অন্য যানবাহন বা অন্য কোন ধরনের জিনিস গাড়ির বডির সাথে লাগার আগে প্রথমে বাম্পার টাচ করে।

আসন ও জানালা

গাড়িতে সাধারণত দুই ধরনের সিট থাকে; ফ্রন্ট সিট এবং ব্যাক সিট। বড় গাড়িতে যেগুলোতে যাত্রী ধারণক্ষমতা বেশি থাকে সেগুলোতে সিটও বেশি থাকে। সিটের সাথে ড্রাইভার আর রাইডারদের সুরক্ষার জন্য সেফটি সিটবেল্ট থাকে। অন্যদিকে, জানালা হচ্ছে গাড়ির অবাধে বায়ু চলাচলের প্রধান মাধ্যম।

গিয়ার স্টিক

গিয়ার স্টিক দিয়ে গাড়ির গতিপথ আর গিয়ার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ড্রাইভার গিয়ার স্টিক ব্যবহার করে গাড়ির‌ মোডস আর গিয়ার পরিবর্তন করতে পারেন। গিয়ার স্টিক শব্দটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিশনে থাকাকালীন একটি ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশনের শিফট লিভারকে বোঝায়।

উইন্ড শিল্ড এবং ওয়াইপার

উইন্ড শিল্ড হলো গাড়িতে আগত হাওয়ার চাপ থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত কাঁচের শিল্ড। এটি গাড়ির পিছনে ও সামনে লাগানো থাকে। উইন্ড শিল্ডকে ধুলাবালি এবং বৃষ্টি থেকে পরিষ্কার রাখার জন্য ওয়াইপার ব্যবহার করা হয়।

শেষ কথা

গাড়ির ৩০ হাজার যন্ত্রাংশের প্রতিটিই তার নিরবচ্ছিন্ন চলাচলের জন্য কোনো না কোনোভাবে দায়ী। তাই গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের নাম ও এর কাজ সম্পর্কে ধারণা থাকা গাড়ির চালক ও কারিগরদের জন্য বিকল্প নয় বরং প্রয়োজনীয়তা। গাড়ির অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশগুলো সরাসরি এর কার্যকারিতায় প্রভাব রাখে। আর গাড়িকে সুরক্ষা প্রদান করে এর বাহ্যিক যন্ত্রাংশগুলো। গাড়ির মডেল ভেদে যন্ত্রাংশে পার্থক্য রয়েছে, তবে এখানে আলোচিত যন্ত্রাংশ গুলো সব গাড়িতে থাকা বাধ্যতামূলক।

® প্রহরী